‘সবকিছু নৈতিক, ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও সামাজিক বচন, ঘোষণা ও প্রতিশ্রুতির পেছনে কোনো না কোনো শ্রেণীর স্বার্থ আবিষ্কার করতে না শেখা পর্যন্ত লোকে রাজনীতির ক্ষেত্রে চিরকাল প্রতারণা ও আত্মপ্রতারণার নির্বোধ বলি হয়ে ছিল এবং চিরকাল থাকবে। পুরনো ব্যবস্থার রক্ষকদের কাছে সংস্কার ও উন্নয়নের প্রবক্তারা সর্বদাই বোকা বনবে যদি না তারা এ কথা বোঝে যে, যত অসভ্য ও জরাজীর্ণ মনে হোক না কেন “প্রত্যেকটি পুরনো প্রতিষ্ঠানই টিকে আছে কোনো না কোনো শাসক শ্রেণির শক্তির জোরে। এবং এই সব শ্রেণীর প্রতিরোধ চূর্ণ করার শুধু একটি উপায়ই আছেঃ যে শক্তি পুরনোর উচ্ছেদ ও নূতনকে সৃষ্টি করতে পারে – এবং নিজের সামাজিক অবস্থানহেতু যা তাকে করতে হবে – তেমন শক্তিকে আমাদের চারপাশের সমাজের মধ্য থেকেই আবিষ্কার করে তাকে শিক্ষিত ও সংগ্রামের জন্য সংগঠিত করে তোলা।” — লেনিন। কিংবা
মাও সে তুং। গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের প্রতিষ্ঠাতা, গেরিলা সংগঠক, চীনা বিপ্লবী, মার্কসবাদী তাত্ত্বিক ও এক অবিসংবাদিত রাজনৈতিক নেতা। ইতিহাসের চাকা বারবার বদলে দিয়েছেন চৈনিক এই মানুষটি। তিনি শ্রমিকের বদলে কৃষককে চিহ্নিত করেছেন বিপ্লবের মূল চালিকাশক্তি হিসেবে, গড়ে তুলেছেন সশস্ত্র রেড আর্মি, প্রচলন করেছেন আরণ্যক গেরিলা যুদ্ধের। এসকল মানুষের জীবনী চরমভাবে আকৃষ্ট করে মুক্তাকে। তার পড়া লেখার সাজানো টেবিলে এসব মনীষীদের জীবনীমূলক বই প্রচুর রাখা আছে। ছোট বেলা থেকেই বই পড়ার প্রতি ভীষণ আগ্রহী সে।
তারও আগে –
ডারউইনের বিবর্তনবাদের সূত্র কিংবা নিউটনের সূত্র চরমভাবে আকর্ষণ করে মুক্তাকে। মানুষের জন্ম আবার তার মৃত্যু নিয়ে অনেক বিশ্লেষন করে মেধাবী মুক্তা। এ নিয়ে সহপাঠী কিংবা বন্ধুদের সাথে বিতর্কে জড়াতে ভীষণ পছন্দ করে সে। তার বন্ধুরা এ নিয়ে তাকে খারাপ ভাবলেও সে কিন্তু উপভোগ করে। বন্ধুদের অনেকে তাকে নাস্তিক, কেউবা অন্য ধর্মে চলে গেছে বলে বেড়ালেও সে এসব ব্যাপারে মোটেও পাত্তা দেয়না। তার কাছে পৃথিবীটা নিছকই উপভোগের জায়গা। এখানে এসেছি উপভোগ করতে , তারপর একদিন মরে যাবো- পঁচে গলে যাবো- এইতো আমার শেষ! এখানে আবার কিসের এতা অলীক ভবিষ্যত ভাবনা ?
কিন্তু তার বন্ধুদের সাথে এ নিয়ে তর্ক কখনো সে এড়িয়ে যায়না। বরং সে তাতে ভীয়ণ আগ্রহী।একদিন তার বন্ধু রবিনের সাথে তো ভীষণ বাকযুদ্ধ! রবিন বুঝাতে চেষ্টা করে, এ পৃথিবীই শেষ নয়, মরার পরেও একটা জীবন আছে, সে জীবন অনন্ত। এই পৃথিবীতে যে যেমন কর্ম করে যাবে তার ফল সেখানে ভোগ করবে, হয় স্বর্গ না হয় নরক হবে ঠিকানা — ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু, মুক্তা পাল্টা শক্তিশালী যুক্তি উপস্থাপন করে, আমি যখন মরে যাবো তখন পঁচে-গলে যাবো। আর এর মধ্য দিয়েই আমার চূড়ান্ত পরিসমাপ্তি ঘটবে। কিসের আবার বিচার, কিসের আবার স্বর্গ-নরক ? আপেল পঁচে গেলে ওটা আর হাতেও নেয়া যায়না। – বিতর্কের এক চূড়ান্ত রূপ ধারণ করে দুজনের মধ্যে। তারপর….
প্রতিদিনের মতো মুক্তা ঘুমিয়ে পড়েছে। রাত আনুমানিক ভরদুপুর। হঠাৎ অজানা আঁতঙ্কে চোখে ভয়ঙ্কর রূপ! অচেনা এক ভয়ঙ্কর চেহারধারী মানুষ সামনে হাজির, তারপর পাশে শুয়ে পড়লো। বাঁধা দিতে চাইলো মুক্তা, কিন্তু কাজ হলো না। তারপর খোশগল্প শুরু করলো লোকটি। মুক্তা ভয়ে জবাব দিতে পারছে না! মাঝে মাঝে জবাব না দিয়েও উপায় নেই! এক পর্যায়ে কথার ফাঁকে অন্য এক রূপ ধারণ করলো লোকটি! আতঙ্কে কেঁপে উঠলো মুক্তা।
এ অচেনা মানুষ কোথা খেকে হাজির ?
কেনই বা এখানে আসলো ?
– এমন হাজারো প্রশ্ন ভীতু মনে জাগ্রত হতে লাগলো…
কিছুক্ষণ পরই তর্কে জড়িয়ে পড়লো লোকটি। মুক্তাও প্রতিউত্তর দিতে লাগলো। কিন্তু আশ্চর্য্য বিষয়, সে অনেক কিছু বলতে চাইলেও বলতে পারছে না ! অবশেষে তাদের এ বাকযুদ্ধ শারিরীক যুদ্ধে রূপ ধারণ করলো। সে এক ভয়ঙ্কর কিল-ঘুষি মারা শুরু হলো। মুক্তাও জানপ্রাণে আঘাত করতে লাগলো। হঠাৎই কেটে গেলো এ আবছা ঘোর ! লোকটি তার সামনে থেকে চলে গেল! মুক্তার বুঝতে বাকি রইলো না, এতোক্ষণ যা ঘটেছে সবই ঘুমের মধ্যে —!
কিন্তু, হাত দিয়ে রক্ত ঝরছে ! মুক্তার আবিষ্কার করতে বাকি নেই যে, তার সকল কিল-ঘুষিই বিছানার পাশে দেয়ালের মধ্যে লেগেছে !
– এ কী করে সম্ভব ?
– তখন অনেক কিছু বলতে চাইলেও কেন মুখ দিয়ে কথা আসছিল না ?
– তখন এতো ভয়ানক পরিবেশ কেন ছিল ?
– কেনইবা আমার এতো কষ্ট হচ্ছিল ? – এমন হাজারো প্রশ্ন মনে ঘুরপাক খেতে লাগলো—!
ভাবনায় পড়ে গেল মুক্তা —-
– তাহলে কী রবিনের কথা ঠিক ?
মৃত্যুর পরেও আরেক জীবন আছে ! না, এটা কি করে সম্ভব ? পঁচে গেলে আবার থাকে কী ?
কিন্তু ভাবনা তার পিছু ছাড়ছে না —! ভাবতে লাগলো সম্ভবতো হতেও পারে—!
– কারণ , আমি তো ঘুমে ছিলাম, আমি জানি ঘুমের মধ্যে মানুষের দৈহিক উপস্তিতি থাকেনা । ঘুমতো এক ধরণের মৃত্যূই।
– তাহলে সেখানে আমি এতা অশান্তিতে ছিলাম কি করে ?
– ভয়ানক রূপ ধারণকারী লোকটার অস্তিত্বই বা আমি টের পেলাম কি করে ?
– এসবই তো আমার অস্তিত্বহীন অনুভূতি !
তবে কেন আমি মরে গেলেও আমার আত্মার অশান্তি সম্ভব নয় ? – অবশ্যই সম্ভব। আমার মৃত্যুর পর জাগতিক উপস্থিতি ছাড়াও আল্লাহ ইচ্ছে করলে আমাকে কষ্ট অথবা সুখ যেকোনটি দিতে পারেন – রবিনের এ কথাটি তাহলে সত্য।
– তবেতো আল্লাহ একজন আছেন, তিনিই এসবের নিয়ন্তা।
কিন্তু, আমি যে গতকাল রবিনের সাথে এসব নিয়ে তর্কে অনেক অন্যায় করেছি—!
– তাহলে আমার এতাদিনের ধারণা পুরোটাই ভুল ! কিন্তু, আমি যে আমার পাঠ্য বইয়ে এসব ধারণা পড়েছি ?
না , রবিনের সাথে আমার আচরণ ঠিক হয়নি । বের হই, ওর সাথে দেখা করতে হবে—!
তারপর রবিনের সাথে দেখা হলো কি না জানিনা, তবে মুক্তার মনোস্ত্বাত্বিক একটা বিশাল পরিবর্তন হয়ে গেছে – এটা বলাই যায়।
( চলবে)
এস এম জাহাঙ্গীর আলম
লেখক ও কলামিস্ট